কাজুবাদামের চাহিদা বিশ্বজুড়ে। কৃষিপণ্যটি রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। দেশের পার্বত্যাঞ্চলেও সম্প্রতি কাজুবাদাম উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্যের তালিকায় উঠে এসেছে কৃষিপণ্যটি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সুষ্ঠু উৎপাদন প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো পেলে কাজুবাদাম দেশের পার্বত্যাঞ্চলের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
পার্বত্য এলাকার কৃষকদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যান উন্নয়ন বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে অন্তত চার দশক ধরে বিভিন্ন ফলের পাশাপাশি কৃষকদের সরবরাহ করা হচ্ছে কাজুবাদামের চারা। এসব চারা দিয়ে তৈরি কাজুবাদামের বাগানে পরবর্তীতে ফলও আসা শুরু করে। কিন্তু এর অধিকাংশই অবিক্রীত থেকে যাওয়ায় কৃষকরা হতাশায় বাগানের গাছ কেটে ফেলতে শুরু করেন।
পরে এ অবস্থায় পরিবর্তন আসে ২০১২ সালের দিকে। ওই বছর স্বল্প পরিমাণে হলেও কয়েকটি দেশে পাহাড়ে উৎপাদিত কাজুবাদাম রফতানি করা হয়। প্রতি মণ বাদাম বিক্রি করা হয় মানভেদে ৫০০-৭০০ টাকায়। এর পরই কৃষকদের মধ্যে নতুন করে কাজুবাদাম নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এখন এখানে উৎপাদিত কাজুবাদামের মণ সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবাদে যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বান্দরবানের ৪ দশমিক ৮ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে কাজুবাদাম উৎপাদন হবে। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন ৭০০ কৃষক। সবচেয়ে বেশি বাগান রয়েছে থানচি ও রুমা উপজেলায়। রাঙ্গমাটিতে কাজুবাদাম উৎপাদন হচ্ছে ২০ হেক্টর জমিতে। এ জেলায় আবাদ বেশি হচ্ছে বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায়। অন্যদিকে খাগড়াছড়িতে বাণিজ্যিকভাবে কাজুবাদাম উৎপাদন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খাগড়াছড়ির উপপরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন।
সূত্র আরো জানায়, পাহাড়ের পতিত ভূমিতে সামান্য পরিচর্যায় প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৮ টন কাজুবাদাম পাওয়া সম্ভব। গত বছর বান্দরবানে ৭ দশমিক ২ টন ও রাঙ্গামাটিতে পাঁচ টন কাজুবাদাম উৎপাদন হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু বাদাম হিসেবেই নয়, কাজু ফলের (কাজু আপেল) খোসারও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উত্কৃষ্ট মানের জৈব বালাইনাশক তৈরি করা সম্ভব, যা নিরাপদ ফসল ও খাদ্যোৎপাদনে অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে কাজু আপেলের জুসও বেশ জনপ্রিয়। ফলের রস সংগ্রহের পর অবশিষ্ট মণ্ড বা ছোবড়া দিয়ে জৈব সার উৎপাদন করা যায়। ফলে সবদিক থেকেই কাজুবাদাম একটি লাভজনক কৃষিপণ্য।
কাজুবাদাম আবাদ নিয়ে কথা হয় থানচি সদরের হেডম্যান পাড়ার বাসিংমং মারমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ১২ বছর আগে তিনি ৫০০ চারা দিয়ে কাজুবাদামের বাগান করেন। চারা রোপণের পাঁচ বছরেই গাছে ফল আসে। কিন্তু শুরুতে কেউ বাদাম কিনত না। তবে ছয় বছর ধরে বিক্রি বেশ ভালো হচ্ছে। একই সঙ্গে বছর বছর দামও বাড়ছে। তাই পরবর্তী সময়ে তিনি আরো ১ হাজার ৬০০ চারার বাগান করেছেন। প্রস্তুত করছেন নতুন জমি। তিনি আরো বলেন, গত বছর ৩৫ মণ কাজুবাদাম বিক্রি করেছি। সম্প্রতি বাগানে ফুল ফুটেছে। কোনো কোনো গাছে ফলও ধরেছে। আশা করছি, গত বছরের চেয়ে এবার ফলন বেশি হবে।
এ উপজেলার রুংবেত পাড়ার তাইতং ম্রো ও মাংলো ম্রো জানান, তারা গত বছর যথাক্রমে ৮০ ও ১০০ মণেরও বেশি কাজুবাদাম বিক্রি করেছেন। ভালো দাম পাওয়ায় বাগান সম্প্রসারণের কথা জানিয়েছেন রুমার বটতলীপাড়ার আগ্যমং মারমা, রনিনপাড়ার লাল লুংয়ান বম ও রোয়াংছড়ির সোয়ানলুপাড়ার লালচুয়ান বম ও লালহুম বম।
তারা জানান, তাদের আগেও অনেকে কাজুবাদামের বাগান করেছিলেন। কিন্তু টানা কয়েক বছর উৎপাদিত বাদাম বিক্রি না হওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েন। অনেকে কাজু বাগানে অন্য ফলের চাষ শুরু করেন। তবে কয়েক বছর ধরেই তাদের মতো আরো অনেকেই নতুন করে কাজুবাদাম আবাদ শুরু করছেন।
রুমা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে কাজুবাদাম আবাদের জন্য একরপ্রতি ২০০টি গাছ রাখা ভালো। এতে বাগানের সঠিক পরিচর্যা করা যাবে, ফলনও ভালো হবে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে কাজুবাদাম গাছে ফুল আসে। ফল সংগ্রহ শুরু হয় মে-জুনে। তবে পাহাড়ে আবাদের জন্য কাজুবাদামের জাত নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাঙ্গামাটির উপপরিচালক পবন কুমার চাকমা।
কৃষিপণ্যটির সম্ভাবনা নিয়ে কৃষি অধিদপ্তর বান্দরবানের উপপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, কাজুবাদাম আবাদ মোটামুটি সহজ। তবে বাদাম বিক্রি করতে গিয়ে মূল সমস্যা দেখা দেয় প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে। কারণ কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত না করে খাওয়া যায় না। কিন্তু পাহাড়ে উৎপাদিত কাজুবাদাম প্রক্রিয়াকরণে সরকারি কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে সরকারিভাবে প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করা গেলে যেমন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, বাড়বে কৃষিপণ্যটির আবাদ, যা পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উত্তর সমূহ